ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী লাভের প্রেক্ষাপট/পটভূমি ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী লাভ | প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব

গ' বিভাগ

বাংলার ইতিহাস। অনার্স তৃতীয় বর্ষ।

অজকের আলোচনা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী লাভের প্রেক্ষাপট/পটভূমি ও গুরুত্ব।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী লাভের প্রেক্ষাপট/পটভূমি ও গুরুত্ব আলোচনা কর।
কোম্পানির দেওয়ানী লাভ


প্রশ্নঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী লাভের প্রেক্ষাপট/পটভূমি ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

 উত্তর:  ভূমিকা: বাংলা তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রভূত্ব স্থাপনের ইতিহাসে দেওয়ানি লাভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইংরেজরা এদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আগমন করলেও ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ভিক্তি স্থাপন করেন। এবং ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের মাধ্যমেই এদেশে কোম্পানির আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত ঘটে আর এ ঘটনা পরম্পরায় তাদের বাংলা ও ভারত বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হয়। এমন কি কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভকে বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ প্রভূত্ব স্থাপনের তৃতীয় ও শেষ অধ্যায় বলে অভিহিত করা যায়।
দেওয়ানি লাভের পটভূমি: ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি হস্তান্তর করা হলেও এর পশ্চাতে যে সকল পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ কাজ করেছিল তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১.মুঘল আমলে ইংরেজদের আগমন: মুঘল আমলে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসে এবং ধীরে ধীরে তারা বাণিজ্য বিস্তার করে। ১৬৫১ সালে বাংলার সুবাদার শাহ সুজার সময় তারা ৩,০০০ টাকার বার্ষিক রাজস্বের বিনিময়ে বাংলায় অবাধ বাণিজ্যের অধিকার পায়। ১৬৮০ সালে মুঘল সম্রাটের ফরমানের মাধ্যমে সামান্য কর প্রদানের শর্তে পুরো সাম্রাজ্যে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়।
২.বাণিজ্য কুটিতে দুর্গ নির্মাণ: ১৬৯৬ সালে সুবাদার ইব্রাহিম খানের অনুমতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুতানটির বাণিজ্য কুটিতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে এবং দুর্গটি সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সুরক্ষিত করে, যা তাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের ভিত্তি স্থাপন করে। কিন্তু পরবর্তীতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কোম্পানিকে দূর্গ নির্মাণ করতে বাধা দেয় ফলে নবাবের সঙ্গে কোম্পানির দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
৩.ফররুখ শিয়ারের ফরমান লাভ: ১৭১৩ সালে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে বাহাদুর শাহের পৌত্র ফররুখ শিয়ার দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন ইংরেজদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে মুঘল সম্রাট ১৭১৭ সালে এক ফরমান দ্বারা বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্য অধিকার প্রদান করেন।
৪.ইংরেজদের জমিদারি লাভ: ১৬৯৬ সালে ইংরেজরা সুতানটি নামে যে নব-কুঠির নির্মাণ করেন তা সুরক্ষিত করার অধিকার লাভ করেন। ১৭০০ সালে ইংরেজরা কলকাতায় একটি দুর্গ নির্মাণ করে ইংল্যান্ডের তদানীন্তন রাজা তৃতীয় "উইলিয়ামের নামানুসারে নাম রাখেন ফোর্ট উইলিয়াম।
৫.পলাশীর যুদ্ধ: ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পরিকল্পিতভাবে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে রবার্ট ক্লাইভ বাংলা তথা ভারত বর্ষে ইংরেজ শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। এবং নবাব মুহাম্মদ বেগ কর্তৃক নিহত হন। কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের ফলে ১৭৬৫ সালে ক্লাইভের নেতৃত্বে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দেওয়ানি লাভ করেন।
৬.বক্সারের যুদ্ধ: নবাব মীর কাসিমের সময় এক পর্যায়ে কোম্পানির সাথে বিরোধ দেখা দেয়। ইংরেজ ও নবাবের সাথে কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের প্রান্তরে মীর কাসীম, শাহ আলম ও সুজা-উদ-দৌলার সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের পথ পরিস্কার হয়। এ আধিপত্য বিস্তারের থেকে পরে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করেন।
৭.কোম্পানির দেওয়ানি লাভ: মীর কাসিম চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ায় কোম্পানি মীর জাফরের নাবালক পুত্র নজিমুদ্দৌলাকে বাংলার নতুন নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করেন। অন্যদিকে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের সাথে কোম্পানির পক্ষের বার্ট ক্লাইভ বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব দানের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রার্থনা করেন। অতঃপর ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা ও বাংলার নবাবকে ৫৩ লক্ষ ৮৬ হাজার ১ শত ৩১ টাকা ৯ আনা রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন।
দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের গুরুত্বকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এ দুই ভাগে বিভক্ত করে নিম্নে আলোচনা করা হল।
(ক) দেওয়ানি লাভের রাজনৈতিক গুরুত্ব: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের রাজনৈতিক গুরুত্বের বিভিন্ন দিক নিম্নে দেওয়া হলো:
১.কোম্পানি রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে মর্যাদা লাভ: দেওয়ানি লাভের পূর্বে কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান যারা এদেশে শুল্কের বিনিময়ে বানিজ্য করত অন্য কোনো বিষয়ে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি রাজস্ব আদায়কারীর মর্যাদা লাভ করেছিল।
২.দিল্লির সম্রাটের ক্ষমতা হ্রাস: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের ফলে দিল্লির সম্রাটের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, সম্মান ও মর্যাদা বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়। দিল্লির সম্রাট কোম্পানির পেনশনভুক্ত অধিকর্তায় পরিণত হয়।
৩.নবাব হাতের পুতুল: দেওয়ানি লাভের পর বাংলার নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হয়। কারণ নবাবের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ছিল না। যেহেতু রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে ছিল তাই নবাবের নিজস্ব কোনো অর্থ ভান্ডার ছিল না। এতে নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিনত হয়েছিল।
৪.কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠা: ১৭৬৫-১৭৭২ সাল পর্যন্ত কোম্পানির পরোক্ষ শাসন ব্যবস্থার ফলে জনগণের অসন্তোষ ও চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সময় ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে কোম্পানির গভর্নর নিযুক্ত হয়ে নবাবকে বাংলার শাসন দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি দেন এবং তার জন্য বার্ষিক ১৬ লক্ষ টাকা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এভাবে ইংরেজরা প্রকাশ্যভাবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসকরূপে এদেশের রাজনৈতিক জীবনে অবতীর্ণ হয়।
৫.কোম্পানির বিচার ক্ষমতা: কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করায় রাজস্ব আদায় ছাড়াও দেওয়ানি মামলার বিচারের দায়িত্বও ছিল দেওয়ানের কর্তব্য কার্যের মধ্যে। যার ফলে কোম্পানি সারা বাংলার বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
(খ) দেওয়নি লাভের অর্থনৈতিক গুরুত্ব: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিম্নরূপ:
১.কোম্পানির আর্থিক সমস্যার সমাধান: তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডে যুদ্ধবিগ্রহের দরুন যে অর্থের টানাটানি পড়েছিল তার ফলে মাতৃদেশ থেকে অর্থ আমদানি করে এ দেশে কোম্পানির পক্ষে ব্যবসায় বাণিজ্য চালানো সম্ভবপর ছিল না। এমন অবস্থায় কোম্পানির দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে ইংরেজদের আর্থিক সমস্যা অনেকটা মিটেছিল। কারণ  দেওয়ানি লাভ করার ফলে তারা এ দেশ থেকেয় রাজস্ব পেতে থাকে।
২.বাংলার কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস: দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের যে নীতি গ্রহণ করে তার ফলে কৃষি অর্থনীতিতে ধস নামে। প্রত্যেক বছর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ের কঠোরতা সহ্য করতে না পেরে অনেক কৃষক তাদের কৃষিকাজ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।
৩.কোম্পানির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন: প্রতিবছর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি ও তা কঠোরভাবে আদায় এবং দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে কোম্পানির অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
৪.বাংলার ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণির দুর্দশা: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলার ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণির সমাধি রচিত হয়। কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। শুধুমাত্র বাংলার অভ্যন্তরে নয়, তারা বাংলার বাইরেও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হয়। ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাংলার অনেক ব্যবসায়ী ও বণিক নিজেদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুঘল আমলে ইংরেজ বণিকরা বাংলায় বাণিজ্য করার জন্য আসেন এবং ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার পথ সৃষ্টি করেন এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে সব বাধাকে চিরতরে দূর করেন। কিন্তু বাধা দূর হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ না করে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করে ভারতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। আর এই অভিনব কৌশল হলো-রাজস্ব তথা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ। এ দেওয়ানি লাভের মধ্যদিয়ে কোম্পানি ভারতের অঘোষিত সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন